• Breaking News

    Friday, February 10, 2017

    না আসুক দুঃসহ স্মৃতি

    না আসুক দুঃসহ স্মৃতি-Bamngla Health Tips




    দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হই। কখনো কখনো এমন কিছু দুর্ঘটনা ঘটে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত ও আকস্মিক। হয় নিজেরাই সেই দুর্ঘটনার শিকার হই অথবা হই প্রত্যক্ষদর্শী। চোখের সামনে হয়তো কাউকে দেখি, বাসচাপা পড়ে রক্তাক্ত হয়ে কাতরাতে, ক্যাম্পাসে হয়তো আমার সামনেই প্রতিপক্ষের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেউ অথবা নিজেই হই আক্রমণের শিকার, ঝড়-বন্যায় আমার অসহায় দৃষ্টির সামনেই মৃত্যু ঘটে প্রিয়জনের। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেকোনোভাবেই সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই না কেন, তা আমাদের চিন্তার জগেক এলোমেলো করে দেয়, আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। এ ধরনের ঘটনা আমাদের মনে চাপ ও কষ্টের সৃষ্টি করে। এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারও কারও ক্ষেত্রে এ প্রতিক্রিয়া কিছুটা তীব্র হয়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও আসি। বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই তীব্র মানসিক চাপজনিত সমস্যা (একিউট স্ট্রেস রিঅ্যাকশন) কমে আসে। তবে সবাই অতটা সৌভাগ্যবান নন। কারও কারও ক্ষেত্রে এ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। যোগ হয় নতুন নতুন উপসর্গ।
    অথবা প্রাথমিকভাবে কোনো সমস্যা না হলেও পরবর্তীকালে, এমনকি বছর কয়েক পরেও এ দুর্ঘটনার সূত্র ধরেই মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে পারেন অনেকে।
    আঘাত-পরবর্তী এ মানসিক চাপজনিত অসুস্থতাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ বা সংক্ষেপে পিটিএসডি। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো দুর্ঘটনার গণ্ডি ছাড়িয়ে বড় কোনো বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায় হতে পারে এ রোগ। সিডর, আইলা, সুনামির মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, টর্নেডো, হারিকেন, বন্যা, ভূমিকম্প অথবা উপসাগরীয় বা ইরাক যুদ্ধ, ৯/১১ মতো সন্ত্রাসবাদ, অপহরণ, যৌন নির্যাতন বা সড়ক দুর্ঘটনার মতো মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগের শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শীরা পরবর্তীকালে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
    আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপের উপসর্গগুলো ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এসব উপসর্গ ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাপনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ভয়ংকর ওই দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বারে বারে ফিরে আসে। ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো শব্দ, দৃশ্য বা আলোচনা ব্যক্তির মনে সে স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। যেমন, কোনো এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার কারও মনে বৃষ্টির শব্দ সেই আতঙ্ক ফিরিয়ে আনতে পারে। অথবা টেলিভিশনের মারদাঙ্গা ছবিতে গুলির দৃশ্য বা শব্দ যুদ্ধফেরত কোনো সৈনিকের মনে আলোড়ন তুলতে পারে। চলমান ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই স্মৃতি। মনে হয়, যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে জীবনে। ব্যক্তি একই রকম ভয়, আতঙ্ক, বেদনা অনুভব করেন, যেমন অনুভূতি হয়েছিল প্রকৃত ঘটনাটির সময়। রাতে ঘুমাতে গেলেও দুঃস্বপ্নে হানা দেয় সেই স্মৃতি।
    বেদনাদায়ক পরিস্থিতিটি মনে করিয়ে দিতে পারে—এ ধরনের ঘটনা বা ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলেন অনেকে। নির্দিষ্ট ওই ঘটনা সম্পর্কে চিন্তা বা আলোচনা থেকে দূরে থাকেন। নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন চারপাশ থেকে। তাঁরা উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত আচরণ করেন, সব সময় যেন কোনো বিপদের শঙ্কায় মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকেন। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, ঘুম কমে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে শারীরিক নানা সমস্যা যেমন: মাথাব্যথা, শরীরব্যথা বা ম্যাজম্যাজ করা, বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা কাঁপা, খাওয়ায় অরুচি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। অনেকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, প্রত্যক্ষদর্শীরা দুর্যোগ থেকে অন্যদের বাঁচাতে না পারার জন্য অপরাধবোধে ভোগেন। জীবনটা যেন অর্থহীন হয়ে যায়। এ কারণে আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপে আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয় অন্যদের চেয়ে বেশি। অনেকে মাদকাসক্তও হয়ে পড়েন।
    অধিকাংশ মানুষই জীবনে কখনো না কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হন। তবে সবার ক্ষেত্রে আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপ একই মাত্রায় প্রকাশ পায় না। প্রতিকূল পরিস্থিতির ধরন, তীব্রতা, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যক্তিগত দক্ষতার (কোপিং মেকানিজম) ওপর এ বহিঃপ্রকাশ নির্ভর করে। সাধারণত মহিলারা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। যাঁদের নিকটাত্মীয়ের মানসিক রোগের ইতিহাস আছে, যারা শৈশবে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় নয়, তাদের ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ব্যক্তিত্বের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা, যেমন সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, নির্ভরশীল বা অসামাজিক বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিরা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
    আশার কথা হচ্ছে, মানসিক চাপের শিকার ব্যক্তিরাও চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এ জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি ও ওষুধ— উভয়ের মাধ্যমেই চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়া গ্রুপ থেরাপির মাধ্যমে রোগীকে বোঝাতে হয়, এ দুর্যোগে তিনি একা নন।
    তার মতো আরও অনেকেই আছেন এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। প্রয়োজনে মানসিক রোগ-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী উত্কণ্ঠাবিনাশী ও বিষণ্নতারোধী ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। মেডিটেশন, রিলাক্সেশন, ইয়োগা প্রভৃতিও বেশ কাজে লাগে। আর দুর্যোগ-পরিস্থিতির পরপরই এ ব্যাপারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণসহ তাদের আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হলে পরবর্তীকালে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
    মুনতাসীর মারুফ
    চিকিৎসা কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মাদারগঞ্জ, জামালপুর
    সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩১, ২০১০

    No comments:

    Post a Comment