• Breaking News

    Friday, February 10, 2017

    মানসিক রোগ

    মানসিক রোগ-Bangla Health Tips




    আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বিশ্বায়নের যুগে মানসিক স্বাস্থ্যঃ সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের প্রভাব’। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। আজকের স্বাস্থ্যকুশল-এর বিশেষ আয়োজন এ দিবসকে নিয়ে।
    প্রতিপাদ্যের বিচারে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সংস্কৃতি ও তার বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে। সংস্কৃতি বলতে একজন ব্যক্তির মন, মনন, চিন্তাধারা, কার্যকলাপ ইত্যাদি ব্যবহারের ভঙ্গি একটি সমাজের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে বোঝায়। আমরা বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক। বাঙালি সংস্কৃতির অনেক চিন্তাধারা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না।
    বহু রকমের মানসিক রোগ আছে। মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে আমাদের সংস্কৃতি ব্যবহারের ওপর। বাংলাদেশিদের বাঙালি সংস্কৃতি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি থেকে আলাদা। বিশ্বব্যাপী দেশজাতিনির্বিশেষে কিছু কিছু সংস্কৃতি একই রকমের। আবার দেখা যায়, একই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি রূপরেখায় কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন লোকের সংস্কৃতি সব জায়গায় একই রকম নাও হতে পারে। যেমনটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি। তাদের চিন্তা-চেতনা আমাদের দেশের ধ্যানধারণা ও চিন্তা-চেতনার চেয়ে একটু ব্যতিক্রমধর্মী। আবার দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে সূক্ষ্ম ফারাক রয়েছে। এটাও দেখা যায় যে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চায়ও কিছুটা ফারাক রয়েছে। কিন্তু সংস্কৃতির কতগুলো মূল উপাদানে জাতিধর্মনির্বিশেষে বাঙালিদের মধ্যে একই। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, মানসিক রোগ বোঝার ক্ষেত্রে ওই দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে প্রথমেই তাঁদের জানতে হয়। কথায় আছে-এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি। এ কথাটাও আমাদের মনে রেখে কাজ করতে হয়।
    স্বভাব যত সিভিলাইজড হবে সংস্কৃতির পার্শ্বধারাগুলোতে তত পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে।
    ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাসহ নব্বইয়ের গণ-অভুত্থান-এই সময়গুলো আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির পার্শ্বধারাগুলোয় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এখন আমরা আর শুধু মাছে-ভাতে বাঙালি নই; আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়েছে; আমরা প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছি। এই পরিবর্তনের ঢেউয়ের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ও রোগের প্রকাশভঙ্গি এবং চিকিৎসাধারায় পরিবর্তন এসেছে। এমন অনেক রোগ আছে, যা ২০০৭ সালে আমরা পাচ্ছি কিন্তু ১৯৭১ সালে ছিল না। যেমন গণমনস্তাত্ত্বিক রোগ।
    এবার মানসিক রোগের প্রকাশভঙ্গি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ। পৃথিবীর সব দেশে, সব জাতিতে এই রোগের উপস্থিতি রয়েছে। এই রোগের হার শূন্য দশমিক আট থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত। সিজোফ্রেনিয়া রোগ নির্ণয়ের কতগুলো কোর উপসর্গ বা মূল উপসর্গ রয়েছে, যা পৃথিবীর সব দেশে একই রকম। পৃথিবীর নয়টি দেশে পরিচালিত এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার (আইপিএসএস) মাধ্যমে কতগুলো মূল উপসর্গ রোগটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। একে বলে স্মাইডার ফাস্ট র‌্যাংক সিম্পটম। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই সিজোফ্রেনিয়া রোগের কিছু পার্শ্ব উপসর্গ আছে, যা দেশের আর্থসামাজিক ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সিজোফ্রেনিয়া রোগের মূল উপসর্গের পাশাপাশি সংস্কৃতি দ্বারা পার্শ্ব-উপসর্গের ওপরও তীক্ষ্ন নজর রাখতে হয়। এক কথায় বলা যায়, সব ধরনের মানসিক রোগের উপসর্গের ওপরই দেশের আর্থসামাজিক ও সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবে কিছু উপসর্গের পরিবর্তনও ঘটে।
    বিষণ্নতা। পাঁচ থেকে দশ শতাংশ মানুষের মধ্যে এ অসুখটি পাওয়া যায়। পৃথিবীব্যাপী এর মূল উপসর্গ হচ্ছে মনে অশান্তি বোধ। কিন্তু তৃতীয় বিশ্ব তথা বাংলাদেশে বিষণ্নতা রোগ নির্ণয়ে অশান্তি বোধের কথা রোগী অনেক পরে উল্লেখ করেন। এর আগে তাঁরা বিভিন্ন শারীরিক রোগের উপসর্গের কথা বলেন। যেমন-মাথাধরা, শরীরে ব্যথা, জ্বালাপোড়া, অরুচি, যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। মনে অশান্তি বোধ হয়-এ কথাটি বাঙালি পরিবারের একজন নারী সহসা বলতে বাধা অনুভব করেন। তাই বাঙালি সংস্কৃতিতে বিষণ্নতা রোগের ক্ষেত্রে আমরা ‘সোমাটাইজেশন’ বা ‘শারীরিকীকরণ’ বেশি পেয়ে থাকি।
    সুইসাইড বা আত্মহত্যা। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীদের প্রোফাইল একটু অন্য রকম। এখানে কমবয়সী বিবাহিত নারীরা আত্মহত্যা বেশি করে থাকেন। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বেশি বয়সের বিষণ্ন একাকী পুরুষদের সংখ্যা এ ক্ষেত্রে বেশি। সংস্কৃতির বিচারে যে দেশে শিক্ষিতের হার কম ও ধর্মীয় বন্ধন বেশি, তাদের মধ্যে উপসর্গগুলোর প্রকারভেদ বেশি থাকে।
    সংস্কৃতির বিচারে বাঙালি সমাজে পারিবারিক অটুট বন্ধনের কারণে যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগে থাকেন, তাঁরা ব্যাপকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশগুলোয় সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের রোগীদের একাকী কোনো নিবাসে বা অ্যাসাইলামে রাখা হয়। সংস্কৃতির প্রভাব অন্যান্য শারীরিক অসুখের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ও অসুখে বেশি দেখা যায়। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। তবে সংস্কৃতি ও সাহিত্য না জেনে মানসিক রোগ বোঝা এবং তা নির্ণয় করা অনেক কঠিন।
    উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০০৭
    লেখকঃ অধ্যাপক ডা· এ এইচ মোহাম্মদ ফিরোজ
    পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

    No comments:

    Post a Comment